রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

দুবাই-লন্ডনে সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাবেদের ৫৯৭ বাড়ি!

বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এর বিরুদ্ধে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের চাঞ্চল্যকর তথ্য উদ্ঘাটন করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সরকারি ছত্রছায়ায় দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক থেকে ভুয়া ও কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচারের এ ঘটনা দেশে-বিদেশে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাচার করা অর্থ দিয়ে জাবেদ দুবাই, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে মোট ৫৯৭টি বাড়ি ও ফ্ল্যাট কিনেছেন। শুধু যুক্তরাজ্যেই তার ৩৬০টি সম্পত্তি, দুবাইয়ে ২২৬টি, আর যুক্তরাষ্ট্রে ৯টি বাড়ির সন্ধান মিলেছে। এর বাজারমূল্য প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা

অবৈধ ঋণ ও অর্থ পাচারের চিত্র

বিএফআইইউ জানিয়েছে, জাবেদ ২০১৪ সালে ভূমিমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই অস্বাভাবিক লেনদেন বৃদ্ধি পায় তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক হিসাবগুলোতে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ২৩১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়— যার বড় অংশই বেনামি বা অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে।

এই অর্থের একটি অংশ তার মূল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আরামিট গ্রুপের হিসাবগুলোতে স্থানান্তর করা হয়, বাকি অংশ পাঠানো হয় হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে, বিশেষ করে দুবাইয়ের জেবা ট্রেডিং কোম্পানির নামে। পরে সেই অর্থ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে তার বিভিন্ন কোম্পানির হিসাবে পাঠানো হয়।

এছাড়া আরামিট গ্রুপ থেকেও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে হংকং হয়ে টাকা পাচার করা হতো— যা পরে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে তার ব্যক্তিগত কোম্পানিতে যায়।

কোন দেশে কত সম্পত্তি

যুক্তরাজ্য: ৩৬০টি বাড়ি, বাজারমূল্য প্রায় ৩,৮৪০ কোটি টাকা

দুবাই: ২২৬টি ফ্ল্যাট ও বাড়ি, বাজারমূল্য প্রায় ১,১১৫ কোটি টাকা

যুক্তরাষ্ট্র: ফ্লোরিডা ও নিউইয়র্কে ৯টি বাড়ি

এছাড়া স্ত্রী রুকমিলা জামানের নামে দুবাইয়ে আরও ২টি বাড়ি, মূল্য ৭.৫ কোটি টাকার বেশি

সিআইডি’র তথ্য অনুযায়ী, শুধু দুবাইয়েই তিনি ১,২০০ কোটি টাকা পাচার করেছেন, যার বেশিরভাগ বিনিয়োগ করা হয়েছে বার্শা সাউথ, থানিয়া, গালফ কমার্শিয়াল, জাবিল সেকেন্ড, বুর্জ খলিফা ও ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ড এলাকায়।

কাগুজে প্রতিষ্ঠান আর জালিয়াতির কৌশল

বিএফআইইউ ও সিআইডি বলছে, জাবেদ লেয়ারিং (Layering) কৌশল ব্যবহার করে অর্থ পাচারের প্রমাণ আড়াল করতেন।


২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ইউসিবি ব্যাংক থেকে মডেল ট্রেডিং নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ২১ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন হয়— কিন্তু অনুমোদনের আগেই ঋণের অর্থ ছাড় করা হয়।
একইভাবে ইমিন্যান্ট ট্রেডার্স নামে অন্য একটি প্রতিষ্ঠান ২০২০ সালে ২০ কোটি টাকার ঋণ নেয়, যা পরবর্তীতে ইম্পেরিয়াল ট্রেডিং, ক্লাসিক ট্রেডিং ও মডেল ট্রেডিং-এর নামে ঘুরে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে জমা হয়, এবং পরে সেই অর্থ আরামিট সিমেন্টের ঋণ পরিশোধে ব্যবহার করা হয়।

এছাড়া এসএস ট্রেডিং, শাকিল এন্টারপ্রাইজ, সুপিরিয়র রেডি মিক্স কনক্রিট, এন মোহাম্মদ ট্রেডিং করপোরেশন, সাবিসা মাল্টিট্রেডসহ একাধিক কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ নেওয়া হয়— যা ব্যাংকিং নিয়মের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এক মোবাইল নম্বরে ১২ প্রতিষ্ঠানের হিসাব

আরও বিস্ময়কর তথ্য হলো, জাবেদের এক কর্মচারী আব্দুল আজিজের একটিমাত্র মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে ইউসিবি ব্যাংকের ৮টি শাখায় ১২টি কোম্পানির ব্যাংক হিসাব খোলা হয়।
সেসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে:
লুসেন্ট ট্রেডিং, আরামিট ফুটওয়্যার, ক্যাপিটাস অ্যাসেট, জেনেসিস ট্রেড ম্যানেজমেন্ট, ইয়াসিন অ্যান্ড ব্রাদার্স, পদ্মা ট্রেডিং, ক্রিসেন্ট ট্রেডিং, ইম্পেরিয়াল ট্রেডিং, মডেল ট্রেডিং ও ভিশন ট্রেডিং।

বিএফআইইউ মনে করছে, এসব হিসাবের উদ্দেশ্য ছিল দুর্নীতির টাকা ঘুরিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ছড়িয়ে দেওয়া, যাতে মূল উৎস শনাক্ত করা না যায়।

মামলা ও তদন্ত অবস্থা

সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে সিআইডি ইতিমধ্যে মানি লন্ডারিং মামলা করেছে।
২০২৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের হয়। বর্তমানে তাদের দুবাই, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া চলমান বলে সূত্র জানিয়েছে।

তবে জাবেদের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়, ফলে তার বক্তব্য জানা যায়নি।

অর্থ পাচার, ঋণ জালিয়াতি ও রাজনৈতিক প্রভাব— এই তিনটি উপাদানের মিশ্রণই গড়ে তুলেছে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের এই বিশাল বিদেশি সাম্রাজ্য।
অন্তর্বর্তী সরকারের তদন্ত এখন শুধু এই প্রশ্নের জবাব খুঁজছে—
বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা এতদিন কীভাবে নীরব ছিল, যখন একজন ব্যক্তি শত শত ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে হাজার কোটি টাকা পাচার করছিলেন?

শেয়ার করুন