মঙ্গলবার, ৪ নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

আমার চোখে জননেতা তরিকুল ইসলাম একজন সৎ, স্নেহময় ও নীতিবান রাজনীতিকের স্মৃতিচারণ

আব্দুর রহিম রানা, যশোর প্রতিনিধি :
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নৈতিকতা, সততা ও সেবামুখী নেতৃত্বের অভাব আজ ক্রমেই চোখে পড়ে। এমন সময়ে যশোরের মরহুম তরিকুল ইসলামের নাম উচ্চারিত হয় শ্রদ্ধা ও মমতার সঙ্গে। তিনি ছিলেন সেই নেতা, যিনি কখনও ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেননি; বরং মানুষের কল্যাণ, ন্যায্যতা এবং নৈতিক আদর্শকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন।
তার জীবন, চিন্তা, কর্ম এবং মানুষের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক আজও প্রজন্মের জন্য আলোকবর্তিকা হিসেবে আলো ফেলে।
২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর বিকেল ৫টায় ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমি তখন খুলনা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকার ঢাকা অফিসে কাজ করছিলাম। এই মহান নেতার মৃত্যুর সংবাদ শুনেই ছুটে গিয়েছিলাম অ্যাপেলো হাসপাতালে। হাসপাতালে প্রবেশ করে আমি প্রথম মুহূর্তেই অনুভব করলাম এক বিশাল শূন্যতা। চারপাশে যেন সময় থেমে গেছে। শোক, নীরবতা এবং হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উদ্ভূত এক ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছিল। মুহূর্তের মধ্যে তার মৃত্যুর খবর বাতাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে। রাজনৈতিক দল, সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক—সবার হৃদয়ে একই শূন্যতার অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল।
পরদিন, ৫ নভেম্বর, মরদেহটি বিশেষ বিমানযোগে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে যশোরে আনা হয়। আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসেছিলাম যশোরে শুধুমাত্র এই মহান নেতার শেষ জানাজায় অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে। বিমানবন্দরে হাজির হাজার হাজার মানুষকে দেখে আমি নিজেই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। ভিড় এত বিশাল, যে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকরা হিমশিম খেতে থাকলেন। গাড়িবহর শোভাযাত্রার মাধ্যমে মরদেহ বাসভবনে আনা হয়। রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের চোখে কষ্ট, শ্রদ্ধা ও অশ্রুসিক্ত ভাব স্পষ্ট ছিল। কেউ হাত জোড় করে সালাম দিচ্ছিল, কেউবা অশ্রুসিক্ত চোখে মরদেহের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
যশোর কেন্দ্রীয় ঈদগাহে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ১০টার পর খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন থেকে হাজার হাজার মানুষ শহরে প্রবেশ করেন। জনতার ভিড় এতোটাই ব্যাপক যে শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যায়। জানাজার স্থান কেবল ঈদগাহেই সীমাবদ্ধ ছিল না; পার্শ্ববর্তী দক্ষিণে সার্কিট হাউস, পূর্বে প্রধান ডাকঘর, উত্তরদিকে দড়াটানা, পশ্চিমে শিল্পকলা একাডেমি ও সিভিল সার্জন অফিস পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এর পর মরদেহ কারবালা গোরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়।
তরিকুল ইসলাম ১৬ নভেম্বর ১৯৪৬ সালে যশোর শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলহাজ্ব আব্দুল আজিজ এবং মা নুরজাহান বেগমের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। ৬ সন্তানের মধ্যে তিনি তৃতীয় সন্তান। ছোটবেলা থেকেই দায়িত্বশীল, সহানুভূতিশীল ও মেধাবী ছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন যশোর জিলা স্কুলে। ১৯৬১ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর যশোর এমএম কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৬৬ সালে অর্থনীতিতে অনার্সসহ স্নাতক পাশ করেন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
ষাটের দশকে তিনি ছিলেন একজন প্রগতিশীল ছাত্রনেতা। ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ভাসানী ন্যাপে যোগদান করে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা নেন। ৭০-এর নির্বাচনের পর উত্তাল সময়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে বৃহত্তর যশোর জেলায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বহুবার তাকে দেখেছি। তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসলে বোঝা যেত, তিনি যেকোনো বিষয়কে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতেন। একবার পত্রিকার অফিসে যখন আমি নতুন একটি প্রতিবেদন লিখছিলাম, তিনি খাতা হাতে নিয়ে আমাকে বলেছিলেন— “রানা, লেখার মাধ্যমে মানুষকে জানাও, কিন্তু কখনো সত্যকে ভয় পেও না। সততা কখনো বিক্রি করা যাবে না।”
এই বাক্যটি আমার সাংবাদিকতার নৈতিক দিকনির্দেশনা হয়ে গেছে। তিনি আমাদের পত্রিকার কর্মীদের জন্য নন, বরং সব সাংবাদিকের জন্য আদর্শ ছিলেন। তিনি চাইতেন সংবাদ কেবল তথ্যমুখী না হয়ে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও উপস্থাপন করা হোক।
তিনি রাজনীতিতে ছিলেন বিনয়ী, নীতিবান এবং সহিষ্ণু। ক্ষমতায় থেকেও অহংকার দেখাতেন না; বিরোধীদের প্রতি সদয় ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সহকর্মীরা তাঁকে বলতেন, “তিনি আমাদের নৈতিক দিকনির্দেশনা।” সাধারণ মানুষ মনে রাখে, “তিনি মানুষের মন্ত্রী, দলের নয়।”
তার মানবিকতা শুধু রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। গ্রামীণ এলাকায় স্কুল, কলেজ, স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের ক্ষেত্রে তিনি সরাসরি তহবিল প্রদান করতেন। শিশু ও কিশোরদের শিক্ষার জন্য নিয়মিত বৃত্তি দিতেন। একবার একটি দুর্গম গ্রামে নতুন বিদ্যালয় উদ্বোধনের সময় আমি তাঁর পাশে ছিলাম। প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা তাকে দেখে আনন্দে ঝাপিয়ে পড়ে। তিনি প্রতিটি শিশুর সঙ্গে আলিঙ্গন করলেন, তাদের সঙ্গে হাসি-খুশি ভাগ করলেন। এই দৃশ্য দেখেই বোঝা যায়, নেতা পদ বা ক্ষমতার জন্য নয়, মানুষের সঙ্গে হৃদয়ে যুক্ত থাকাটাই সত্যিকারের নেতৃত্ব। তিনি মানুষের সঙ্গে হৃদয়ে যুক্ত ছিলেন।
তিনি গণমাধ্যমের সততা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি স্থাপন করেছিলেন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা দৈনিক লোকসমাজ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।
পত্রিকাটির লক্ষ্য ছিল সমাজে সত্য ও ন্যায়ের কণ্ঠস্বর জাগিয়ে তোলা। আমি সৌভাগ্যবান যে দৈনিক লোকসমাজ-এর প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সেখানে একজন সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তিনি আমাকে কখনো কর্মী হিসেবে দেখেননি; বরং পরিবারের সদস্য হিসেবে দেখতেন। নিয়মিত আমার লেখা পড়তেন, পরামর্শ দিতেন এবং সাংবাদিকতার নৈতিক মান বজায় রাখার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। প্রতিদিন তিনি অফিসে এসে আমাদের সঙ্গে চা খেতেন, লেখা পড়তেন, সংশোধন করতেন। এবং খবরের দিকনির্দেশনা দিয়ে আমাকে শেখাতেন—একজন অভিভাবকের মতো আন্তরিকতায়। তিনি সাংবাদিকদের প্রতি এমন যত্নশীল ছিলেন, যে তারা শুধু সংবাদই নয়, মানবিক দৃষ্টিকোণেও খবর উপস্থাপন করতে শিখতো। একদিন তাঁকে বলেছিলাম, “স্যার, আপনার পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে আমি অনেক কিছু শিখছি।” তিনি মুচকি হেসে বললেন,— “রানা, সাহসী হও। সংবাদ লিখো, কিন্তু সততা কখনো ছাড়ো না।”
তরিকুল ইসলামের রাজনৈতিক জীবনও অসাধারণ ছিল। তিনি সড়ক ও রেল মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, সমাজকল্যাণ ও মহিলা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, ডাক ও টেলিকমিউনিকেশন মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী, খাদ্য, তথ্য ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে দলের নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
তরিকুল ইসলাম রাজনীতিতে ছিলেন বিনয়ী, নীতিবান এবং সহিষ্ণু। ক্ষমতায় থেকেও অহংকার দেখাতেন না, তার মানবিকতা শুধু রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। গ্রামীণ এলাকায় স্কুল, কলেজ, স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের ক্ষেত্রে তিনি সরাসরি তহবিল প্রদান করতেন। শিশু ও কিশোরদের শিক্ষার জন্য নিয়মিত বৃত্তি দিতেন।
আমি বহুবার দেখেছি, তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলার সময় কতটা আন্তরিক ছিলেন। গ্রামের স্কুল, হাসপাতাল বা কমিউনিটি সেন্টারে নিজে গিয়ে সমস্যা শুনতেন এবং সমাধানের নির্দেশ দিতেন। তিনি সর্বদা বলতেন- “পদ নয়, কাজই নেতা পরিচয়ের মাপকাঠি।”
তার জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, রাজনীতিক হতে হলে কেবল ক্ষমতায় থাকা যথেষ্ট নয়। বড় দায়িত্ব হলো মানুষের কল্যাণ, সততা এবং নৈতিকতা বজায় রাখা। তিনি রাজনীতিকে মানবিক করেছেন, নেতৃত্বকে সেবার সমার্থক করেছেন। তার আদর্শ, কর্ম এবং চিন্তা আজও তরুণ প্রজন্মকে পথ দেখাচ্ছে, সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক নৈতিকতার মান বজায় রাখতে সহায়তা করছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ যখন নৈতিক নেতৃত্বের অভাব নিয়ে আলোচনা হয়, তখন তরিকুল ইসলাম হয়ে আছেন এক প্রেরণার নাম। তিনি দেখিয়েছেন—রাজনীতি মানে ত্যাগ, সততা ও মানুষের কল্যাণ। তাঁর কর্ম, চিন্তা ও ভালোবাসা আমাদের প্রজন্মকে শেখায়—“আদর্শের রাজনীতি কখনো হারায় না, যদি তাতে থাকে মানুষের প্রতি সত্যিকার ভালোবাসা।”
তথ্যসূত্র হিসেবে স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সাক্ষাৎকার, দৈনিক লোকসমাজ আর্কাইভ, উইকিপিডিয়া, প্রথম আলো, বাংলা নিউজ২৪ এবং লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ব্যবহার করা হয়েছে।
শেয়ার করুন