সোমবার, ৩ নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

পাঁচবিবিতে ত্রি-মুখী দ্বন্দ্বে জয়হার মাদ্রাসা,স্থবির শিক্ষাব্যবস্থা 

রেজুয়ান, পাঁচবিবি প্রতিনিধি :
জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার কুসুম্বা ইউনিয়নের জয়হার আমিনিয়া মহাব্বতিয়া দ্বিমূখী দাখিল মাদ্রাসার সুপার, সহকারি শিক্ষক ও অভিভাবকদের মাঝে ত্রি-মুখী অন্তর্দ্বন্দ্বে মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রম ও দাপ্তরিক কাজে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের এই দীর্ঘ দিনের দ্বন্দ্বের ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত দাপ্তরিক কাজ ও পাঠদান কার্যক্রম ব্যহত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ দ্বন্দ্বের শুরু এ মাদ্রাসার শুন্য পদে সুপার নিয়োগকে কেন্দ্র করে। সুপার পদটি শুন্য হলে ২০২৩ সালে সুপার পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর উক্ত পদে আবেদন করেন বর্তমান সুপার আব্দুস সাত্তার। আবেদনের পর তৎকালীন মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও আওয়ামীলীগ নেতা সোহরাব হোসেন মন্ডলের সাথে অবৈধ লেনদেনের বিনিময়ে আব্দুস সাত্তার সুপার পদের জন্য আঁতাত করেন। তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সুপার আজিজার রহমান পদাধিকার বলে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য সচিব হলেও তাকে না জানিয়ে সভাপতি কৌশলে নিয়োগ বোর্ডের সকল প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করেন। পরবর্তীতে মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির অন্যান্য সদস্য ও ভারপ্রাপ্ত সুপারের অজ্ঞাতসারে সভাপতি তার দলীয় প্রভাব খাটিয়ে জয়পুরহাট হাজী মাদ্রাসায় নিয়োগ পরীক্ষার আয়োজন করেন এবং ঐ দিনই অফিসের জরুরী কাজের কথা বলে কৌশলে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য সচিব ভারপ্রাপ্ত সুপারকে ডেকে নেন। ভারপ্রাপ্ত সুপার সেখানে গিয়ে দেখেন নিয়োগ প্রক্রিয়ার সকল কাজ সম্পূর্ণ করেছেন সভাপতি ও তার পছন্দের ব্যক্তিরা । এ সময় চাপ প্রয়োগ করে আজিজারের নিকট থেকে সুপার নিয়োগ বোর্ডের কাগজে উপস্থিতির স্বাক্ষর দিতে চাপ প্রয়োগ করলে তিনি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হোন।
উক্ত বোর্ডে আব্দুস সাত্তারকে ২০২৪ সালে জয়হার আমিনিয়া মহাব্বতিয়া দ্বিমূখী দাখিল মাদ্রাসার সুপার হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। এমন অবৈধ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পাওয়া সুপারকে মেনে না নেয়ায় সুপার ও শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় । এ অবস্থায় আব্দুস সাত্তার সুপার পদে যোগদান না করেই দীর্ঘদিন মাদ্রসায় অনুপস্থিত থাকেন। এসময় তিনি ভারপ্রাপ্ত সুপারের স্বাক্ষর জাল করে নিজের বিল বেতন অনুমোদন করেন। এরপর সুপার আব্দুস সাত্তার ও সভাপতি সোহরাব হোসেন গোপনে অর্ধ কোটি টাকার অবৈধ নিয়োগ বানিজ্যের মাধ্যমে আয়া ও নিরাপত্তা প্রহরী পদে দুইজনকে নিয়োগ দেন। পরে এম পি ও সীটে উক্ত দুজনের নাম আসায় শিক্ষক ও কমিটির সদস্যদের মধ্যে শোরগোল পড়ে যায়।
এই সব অনিয়ম দূর্নীতি ও বিধিবহির্ভূত ভাবে নিয়োগকৃত সুপারের অনুপস্থিতি এবং তার বিতর্কিত কর্মকান্ড নিয়ে এলাকার সচেতন সমাজ ও অভিভাবকরা ঐ সুপারের পদত্যাগের দাবীতে গত ৩১ জুলাইয়ে এলাকায় মানববন্ধন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানের একাধিক শিক্ষক বলেন, আব্দুস সাত্তার সুপার পদে নিয়োগ লাভের পর কোনদিন মাদ্রাসায় আসেননি। এক দুমাস মাস পর পর হঠাৎ একদিন এসে পুরো মাসের হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে আবার অনুপস্থিত থাকেন । এছাড়া গোপনে নিয়োগকৃত কর্মচারী দুজনও কোনদিন মাদ্রাসায় আসেনি। মাদ্রসায় উপস্থিত না থেকে আব্দুস সাত্তার তৎকালীন সভাপতির যোগসাজশে এই সব বিতর্কিত কর্মকান্ড চালিয়ে যান । আর একাজ গুলোতে তাকে সহযোগিতা করেন সুপারের অনুগত আব্দুল আওয়াল নামের একজন সহকারী শিক্ষক। সর্বশেষ এনটিআরসি কর্তৃক দুইজন শিক্ষক এই মাদ্রাসায় সুপারিশ প্রাপ্ত হওয়ায় তাদের প্রতিষ্ঠানের বাহিরে বসে গোপনে যোগদান করে নিলেও মাদ্রাসায় যেতে নিষেধ করেন সুপার সাত্তার।
অপরদিকে ৫আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর মাদ্রাসার সভাপতি পলাতক থাকায় এডহক কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির মেয়াদ শেষ হলে নিয়মিত কমিটির জন্য তফশীল ঘোষিত হয়। ৭ সেপ্টেম্বর নির্বাচনের লক্ষ্যে সুপার আব্দুস সাত্তার নিজের পছন্দের লোককে সভাপতি নির্বাচিত করার জন্য দাতা সদস্যের নাম বাদ এবং ইবতেদায়ী শাখায় কোন ছাত্র/ছাত্রী না থাকলেও ভূয়া ছাত্র/ছাত্রী দেখিয়ে তাদের অভিভাবককে ভোটার তালিকায় নাম যুক্ত করেন। প্রকাশিত তালিকায় দাতা সদস্যের নাম না থাকা ও ভূয়া ভোটার থাকায় মতিয়ার রহমান নামের এক অভিভাবক জয়পুরহাট সহকারী জজ আদালতে মামলা করলে আদালত নির্বাচন স্থগিতের আদেশ দেন। পরবর্তীতে আদালত শুনানীতে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করলে বাদী পুণরায় জেলা জজ আদালতে আপিল করেন। বর্তমানে কমিটি নির্বাচনের মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।
বিষয় গুলি নিয়ে সুপারের বক্তব্য নিতে একাধিকবার মাদ্রাসায় গেলও তাকে পাওয়া যায়নি এবং ফোনও রিসিভ করেননি। তবে পরে দেখা হলে তিনি সকল দায় তৎকালীন সভাপতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেন। তার এ বক্তব্যটি ভিডিওতে রেকর্ড করতে চাইলে পরে দিবেন বলে অফিস থেকে বের হয়ে যান।
এ ব্যাপারে কমিটির সাবেক সভাপতি সোহরাব হোসেন মন্ডল বলেন, সকল নিয়ম অনুসরণ করে মাদ্রসার নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়েছে। নিয়োগে বানিজ্যের অভিযোগটি ভিত্তিহীন।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) তোফাজ্জল হোসেন বলেন, মাদ্রাসার নিয়মিত কমিটি বিষয়ে আদালতে মামলা হলে বিচারক শুনানিতে সুপারের পক্ষে রায় দেন। পরবর্তীতে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিয়মিত কমিটি গঠনের কাজ চলমান রয়েছে। সুপারের মাদ্রাসার অনুপস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে কেউ কোন অভিযোগ দেয়নি। আমি সবেমাত্র অতিরিক্ত দায়িত্বে এসেছি, সত্যতা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শেয়ার করুন