রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: যশোরের মনিরামপুরে মনোনয়নযুদ্ধে বিএনপিতে ৮ প্রার্থী, মাঠে ৬ দল

জেমস আব্দুর রহিম রানা, যশোর :

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে যশোর-৫ (মনিরামপুর) আসনে শুরু হয়েছে তীব্র রাজনৈতিক উত্তাপ। ইতিমধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, জাগপা ও এবি পার্টি নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না থাকায় এবার ভোটযুদ্ধ গড়ে উঠছে মূলত ধানের শীষ ও ইসলামি জোটের প্রার্থীদের মধ্যে।

নির্বাচনী মাঠে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়—কে হবেন বিএনপির মনোনীত প্রার্থী? কারণ, এ আসনে আওয়ামী লীগের বাইরে বিএনপির প্রার্থীরাই দীর্ঘদিন ধরে মূল ভোটের কেন্দ্রবিন্দুতে। মাঠে দেখা যাচ্ছে, একদিকে বিএনপির অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে ইসলামি দলগুলোর সংগঠিত প্রস্তুতি। ফলে মনিরামপুরের রাজনীতি এখন এক জটিল অথচ প্রাণবন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিণত হয়েছে।

বিএনপিতে প্রার্থিতার দৌড়ে রয়েছেন আটজন—অ্যাডভোকেট শহীদ ইকবাল হোসেন, ইফতেখার সেলিম অগ্নি, আসাদুজ্জামান মিন্টু, অ্যাডভোকেট এমএ গফুর, জাহানারা সিদ্দিকী, মুনির আহমেদ সিদ্দিকী বাচ্চু, এবিএম গোলাম মোস্তফা তাজ ও প্রয়াত নেতা মো. মুসার পুত্র কামরুজ্জামান শাহিন। ঢাকায় বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভার্চুয়াল মতবিনিময় সভায় এ আটজনই নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, শুরুতে প্রার্থী ছিলেন ৩–৪ জন, তবে মুসার মৃত্যুর পর নতুনভাবে প্রার্থী বাড়তে থাকে। বর্তমানে মনিরামপুরের রাজনীতিতে ধানের শীষ প্রতীকের মালিকানা নিয়ে চলছে তীব্র আলোচনা। চায়ের দোকান, গ্রামীণ হাট, এমনকি সামাজিক অনুষ্ঠানেও আলোচনার কেন্দ্রে এই প্রশ্ন—“কে হচ্ছেন বিএনপির প্রার্থী?”

অ্যাডভোকেট শহীদ ইকবাল হোসেন বলেন, “আমি দলের মনোনয়ন নিয়ে এর আগে নির্বাচন করেছি। মামলার চাপ ও রাজনৈতিক নির্যাতনের মধ্যেও সংগঠনের কাজ করেছি। এবারও মনোনয়ন পেলে জনগণের ভালোবাসায় বিপুল ভোটে বিজয়ী হবো।” উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মিন্টু জানান, “হাইকমান্ড আমাদের মাঠে কাজ করতে বলেছে, আমরা করছি। ধানের শীষ যিনিই পাবেন, তাকেই বিজয়ী করতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবো।”

অন্যদিকে সাবেক ছাত্রনেতা ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ইফতেখার সেলিম অগ্নি বলেন, “আমি রাজনীতি করি জনসেবার জন্য, কোনো স্বার্থ বা চাঁদাবাজির জন্য নয়। গুম ও হামলার মধ্য দিয়েও জনগণের পাশে থেকেছি। আমার সংগঠনিক অভিজ্ঞতা এবং ক্লিন ইমেজ দল বিবেচনা করবে বলেই আশা রাখি।”

বিএনপির বাইরে ইসলামি ও জাতীয়তাবাদী ধারার ছয়টি দল ইতিমধ্যে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। জামায়াতে ইসলামী থেকে যশোর জেলা কর্মপরিষদ সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট গাজী এনামুল হক প্রতিদিন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে সভা–সমাবেশ ও গণসংযোগ করছেন। তিনি বলেন, “মনিরামপুরের মানুষ পরিবর্তন চায়। আমরা শান্তি, ন্যায়বিচার ও নৈতিকতার রাজনীতি করি। ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠাই আমার লক্ষ্য।”

তিনি আরও বলেন, “আমি রাজনীতি করি ক্ষমতার জন্য নয়, জনগণের কল্যাণের জন্য। বর্তমান সমাজে দুর্নীতি, বেকারত্ব ও অন্যায়ের যে দৌরাত্ম্য, তার অবসানে জনগণ এখন বিকল্প খুঁজছে। আমি বিশ্বাস করি—মনিরামপুরবাসী এবার নীতিনিষ্ঠ ও কর্মক্ষম নেতৃত্বকে ভোট দেবে।”

আরও যোগ করে তিনি বলেন, “আমাদের কর্মীরা তৃণমূল পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে। ইসলামি ভোট ব্যাংক ছড়িয়ে আছে প্রতিটি ইউনিয়নে। সুষ্ঠু ভোট হলে আমাদের প্রার্থীই বিজয়ী হবে। জনগণ যে পরিবর্তনের আশা করছে, জামায়াত সেই আশার প্রতীক হয়ে উঠেছে।”

তার সমর্থনে স্থানীয় এক শিক্ষক বলেন, “গাজী এনামুল হককে মানুষ চেনে সততা ও পরিশ্রমের জন্য। তিনি শিক্ষিত, নীতিবান এবং মাটির মানুষ। তার ভোট বাড়ছে প্রতিদিন।”

জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মুফতি রশিদ বিন ওয়াক্কাসও মাঠে আছেন। তার পিতা মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাস ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছিলেন। এবার তিনিও জোটের প্রার্থী হওয়ার আশায় কাজ করছেন। তিনি বলেন, “আমাদের দল জনগণের আস্থা ফিরে পাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক সাড়া মিলছে।”

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের উপজেলা উপদেষ্টা জয়নাল আবেদীন টিপু বলেন, “নেতা নয়, জনগণের খাদেম হিসেবে কাজ করতে চাই। দুর্নীতি ও দখলবাজিমুক্ত জনপদ গড়াই আমার লক্ষ্য।” খেলাফত মজলিসের প্রার্থী মাওলানা তবিবর রহমানও দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)’র প্রেসিডিয়াম সদস্য ও খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়ক নিজামুদ্দিন অমিত বলেন, “আমরা ক্ষমতার নয়, গণমানুষের রাজনীতি করি। উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও সুশাসন প্রতিষ্ঠাই আমার অঙ্গীকার।” তিনি আরও যোগ করেন, “আমি সাধারণ মানুষের সুখ–দুঃখে পাশে থেকেছি। নির্বাচিত হলে তরুণদের জন্য প্রশিক্ষণভিত্তিক কর্মসংস্থান, কৃষকদের জন্য উৎপাদন–ভিত্তিক ভর্তুকি ও শিক্ষাখাতে বাস্তব পরিবর্তন আনতে চাই।”

অন্যদিকে এবি পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন মো. হাবিবুর রহমান, আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন সাবেক মেজর মোস্তফা বনি। তারা দুজনই সীমিত পরিসরে প্রচারণা চালাচ্ছেন।

উপজেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, যশোর-৫ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৭ হাজার ২৮৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ২৩ হাজার ১৪৫ জন ও নারী ভোটার ১ লাখ ৮৪ হাজার ১৪০ জন। নারী ভোটারের আধিক্য এবার নির্বাচনী সমীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবুল কাশেম জানান, “মনিরামপুরের ভোটাররা অতীতে দলীয় প্রতীক নয়, প্রার্থীর ব্যক্তিত্বকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।” অন্যদিকে এক তরুণ ভোটার বলেন, “আমরা এমন প্রার্থী চাই, যিনি উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে বাস্তব পরিবর্তন আনবেন।”

স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ধানের শীষ প্রতীক কার হাতে উঠবে, সেটিই পুরো সমীকরণ বদলে দেবে। বিএনপি যদি প্রার্থী বাছাইয়ে ঐক্য ধরে রাখতে পারে, তবে এই আসনে তারা শক্ত অবস্থান নিতে পারবে। কিন্তু দ্বন্দ্ব বা বিভাজন দেখা দিলে ইসলামি দলগুলো ভোট বিভাজনের সুযোগ নিতে পারে।

সবশেষে বলা যায়, মনিরামপুরে এবারের ভোটযুদ্ধ কেবল প্রার্থী নয়, আদর্শ ও পরিবর্তনের প্রতিযোগিতা। জনগণ এখন অপেক্ষায়—ধানের শীষের প্রতীক কার হাতে উঠবে, কারণ সেই সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনীতির পরবর্তী অধ্যায়।

শেয়ার করুন