আব্দুর রহিম রানা, যশোর প্রতিনিধি :
যশোরের মনিরামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবলুর রহমান খান ও উপপরিদর্শক (এসআই) মিলন হোসেনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে। জমি দখল, ফসল লুট এবং দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগে উপজেলার নেহালপুর ইউনিয়নের গাবরডাঙ্গা গ্রামের প্রভাষ ঘোষ বাদী হয়ে গত রবিবার (২৬ অক্টোবর) যশোরের বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ মামলা দায়ের করেন। আদালত অভিযোগটি আমলে নিয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে আগামী ২ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে সশরীরে হাজির হয়ে অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন।
আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রে বাদী প্রভাষ ঘোষ উল্লেখ করেন, নেহালপুর মৌজায় তার পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত ৫ একর ১৫ শতক জমি তিনি দীর্ঘদিন ধরে শান্তিপূর্ণভাবে ভোগদখল করে আসছেন। কিন্তু সম্প্রতি স্থানীয় রবিউল হোসেন, আবুল হোসেন, রফিকুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ঐ জমি জোরপূর্বক দখলের চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। এ বিষয়ে তিনি প্রশাসনের সহযোগিতা চাইলেও মনিরামপুর থানার ওসি বাবলুর রহমান খান ও উপপরিদর্শক (এসআই) মিলন হোসেন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেননি, বরং উল্টো পক্ষপাতমূলক আচরণ করেছেন।
প্রভাষ ঘোষ অভিযোগ করেন, ওসির নির্দেশে এসআই মিলন ও তার সহযোগীরা তার জমিতে প্রবেশ করে ধান কেটে নেয়, মাছ ধরে নিয়ে যায় এবং নারিকেল ও সুপারি গাছের ফল সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। এতে আনুমানিক ২৫ লাখ টাকার ফসল ও সম্পদ লুট হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। এ ঘটনায় সোমবার (২৭ অক্টোবর) তিনি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যশোরের উপপরিচালক বরাবরও একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, থানায় গিয়ে আইনগত সহায়তা চাইলে ওসি বাবলুর রহমান খান ও এসআই মিলন হোসেন বাদীকে হুমকি দেন এবং বলেন, “বেশি বাড়াবাড়ি করলে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হবে।” এতে প্রভাষ ঘোষ ও তার পরিবার আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট রতন কুমার দেবনাথ বলেন, “বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালত অভিযোগপত্রে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ দেখতে পেয়ে মামলাটি আমলে নিয়েছেন এবং দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে হাজির হয়ে জবাব দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী এখন আইনি প্রক্রিয়া চলবে।”
এ বিষয়ে মনিরামপুর থানার ওসি বাবলুর রহমান খান সাংবাদিকদের বলেন, “প্রভাষ ঘোষ একজন ভূমিদস্যু। সে প্রতিপক্ষের জমি দখল করাতে পুলিশের সহযোগিতা চাইছিল। আমরা অস্বীকার করায় সে প্রতিশোধ নিতে আমাদের নামে মামলা করেছে। আমরা কোনো পক্ষপাত করিনি; আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা নেব।”
এদিকে ঘটনাটি প্রকাশ পেয়ে এলাকায় তীব্র আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, একটি জমি বিরোধ নিয়ে পুলিশের নাম জড়িয়ে পড়া দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক। নেহালপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা শ্রী মনোজ মণ্ডল বলেন, “আমরা শুনেছি প্রভাষ ঘোষের সঙ্গে ওই জমির বিরোধ অনেক পুরনো। তবে যদি সত্যি পুলিশ এতে জড়িত থাকে, তাহলে তদন্ত করে বিচার হওয়া দরকার।” একই এলাকার যুবক রফিকুল ইসলাম বলেন, “পুলিশ জনগণের নিরাপত্তার প্রতীক। তারা যদি পক্ষ নেন, তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে?”
গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি হরিদাস ঘোষ জানান, “আমরা ছোটবেলা থেকে প্রভাষ ঘোষের পরিবারকে ওই জমিতে চাষ করতে দেখেছি। বিরোধ থাকতেই পারে, কিন্তু প্রশাসনের ভূমিকা হওয়া উচিত নিরপেক্ষ।” এলাকার নারী সংগঠক সালমা বেগম বলেন, “গ্রামে এখন সবাই ভয় পাচ্ছে। কেউই প্রকাশ্যে কিছু বলতে চায় না। আমরা চাই তদন্ত হোক, আর দোষী যেই হোক, তার বিচার হোক।”
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জমি সংক্রান্ত এই বিরোধ নতুন নয়। কয়েক বছর ধরেই উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা চলে আসছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিষয়টি রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে নতুন মাত্রা পেয়েছে। এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
ঘটনাটি এখন পুরো মনিরামপুরে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই বলছেন, এ ধরনের অভিযোগ পুলিশের ভাবমূর্তি ও জনগণের আস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, যদি পুলিশের কোনো সদস্য দায়িত্বে অবহেলা বা ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকে, তবে তা দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। এতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সুনাম বজায় থাকবে এবং সাধারণ মানুষের আইনের প্রতি আস্থা ফিরবে।
মনিরামপুরের এই ঘটনাকে ঘিরে এখন যশোর জেলায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী আগামী ২ ডিসেম্বর দুই পুলিশ কর্মকর্তার হাজিরা ও ব্যাখ্যা প্রদানের দিনটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে স্থানীয় জনসাধারণ। তারা আশা করছেন, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদঘাটিত হবে এবং যারাই দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।





