রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সংস্কারের ম্যান্ডেট জনগণের কাছ থেকেই নিতে হবে-বিএনপি নেতা আমীর খসরু

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিলুপ্ত করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে, এই বিভাগ মূলত রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল—যার মাধ্যমে পছন্দের ব্যক্তিদের এমডি ও পর্ষদ সদস্য হিসেবে বসিয়ে লুটপাটের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

তিনি মনে করিয়ে দেন, বিএনপি অতীতে ক্ষমতায় থাকাকালে এই বিভাগ তুলে দিয়েছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার পুনরায় ক্ষমতায় এসে এটি ফিরিয়ে আনে। আমীর খসরুর দাবি, বিএনপি পুনরায় সরকারে এলে আবারও এই বিভাগ বিলুপ্ত করা হবে।

আমীর খসরু বলেন, অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে শুধু স্বায়ত্তশাসন নয়, পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। পাশাপাশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের কাঠামোগত সংস্কারও বাস্তবায়ন করা হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দুই ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। তাঁর মতে, “দুই ভাগেই যখন একই আমলাতান্ত্রিক কাঠামো বহাল, তখন এর মাধ্যমে কোনো কার্যকর পরিবর্তন আসবে না।” বিএনপির নিজস্ব পরিকল্পনা আছে এনবিআর পুনর্গঠনের বিষয়ে বলেও জানান তিনি।

আমীর খসরু বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আমলাতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করা বা জবাবদিহিতার বাইরে রাখা হবে না। বরং তাদের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব সীমিত করা হবে, যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব আমলাদের নয়, নির্বাচিত নীতিনির্ধারকদের হাতেই থাকা উচিত।”

অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, “দেশ এখন ভয়াবহ জ্বালানি সংকটে। গত ১৫ বছরে নিজস্ব জ্বালানি উৎসে বিনিয়োগ না করে বরং বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনেই মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। এ খাতে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে—যেখানে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির সুযোগ ছিল।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, “অতীত সরকারের প্রবৃদ্ধির মডেল প্রকৃতপক্ষে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বাড়িয়েছে। তথাকথিত অর্থনৈতিক অলৌকিকতার গল্পের আড়ালে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।” তিনি জানান, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে, দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের নিচে নেমে যেতে পারে, আর স্নাতক পর্যায়ের প্রতি তিনজনের একজন বেকার। তাঁর মতে, “বাংলাদেশ এখন এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে—এখন হয় আমরা স্থবিরতা মেনে নেব, নয়তো নতুন অর্থনৈতিক মডেল গ্রহণ করে অভূতপূর্ব সমৃদ্ধির পথে যাব।”

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, “দেশে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। জাতীয় বিনিয়োগনীতি না থাকায় স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি হয়নি। একটি সমন্বিত জাতীয় বিনিয়োগ ও বাণিজ্য উন্নয়ন কৌশল সময়ের দাবি।”

মূল অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আমীর খসরু বলেন, “সংস্কারের দাবি নিয়ে রাস্তায় নয়, জনগণের দুয়ারে যেতে হবে। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েই সংসদে সংস্কার পাস করতে হবে।” তিনি আরও বলেন, “রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে না পারলে শত সংস্কারেও সুফল আসবে না। আমাদের মধ্যে সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তুলতে হবে—দ্বিমত থাকলেও একে অপরের প্রতি সম্মান থাকা জরুরি।”

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য মনজুর হোসেন, জামায়াতে ইসলামীর যুক্তরাষ্ট্রের মুখপাত্র নকিবুর রহমান, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান আরিফ, হিসাববিদ স্নেহাশীষ বড়ুয়া, কাউন্টারপার্টের নির্বাহী সম্পাদক জ্যোতি রহমান, এবং চালডালের সিইও ওয়াসিম আলিম প্রমুখ।

শেয়ার করুন