রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

যশোরের কেশবপুরে ৩৯ বছর পর নিজস্ব জমিতে কালীপূজা

জেমস আব্দুর রহিম রানা, যশোর প্রতিনিধি:
যশোরের কেশবপুর উপজেলার সরাপপুর দক্ষিণপাড়া সর্বজনীন কালিমন্দিরে প্রায় ৩৯ বছর পর নিজস্ব জমিতে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দীর্ঘদিনের বিরোধ ও জমিজটিলতা কাটিয়ে এবার পুনরায় মন্দিরের রেকর্ডকৃত জমিতে পূজার আয়োজন সম্ভব হওয়ায় এলাকাজুড়ে নেমেছে আনন্দ ও উৎসবের জোয়ার।
বিগত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন কারণে এই পূজাটি অন্যত্র অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল। স্থানীয়দের মধ্যে জমির মালিকানা নিয়ে জটিলতা, দলীয় প্রভাব এবং প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতার কারণে মন্দিরের নিজস্ব জায়গায় পূজা করা সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু এ বছর স্থানীয়দের একযোগে প্রচেষ্টা ও প্রশাসনের সহযোগিতায় অবশেষে সেই বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্ন পূরণ হলো।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৬ সালের পর থেকে মন্দিরের জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিরোধ জটিল আকার ধারণ করে এবং পূজা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তবে সম্প্রতি চিংড়া বাজার পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই শামীম হোসাইন শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য উভয় পক্ষের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। তাঁর সক্রিয় ভূমিকা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা এবং এলাকাবাসীর ঐক্যবদ্ধ মনোভাবের ফলেই জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। এসআই শামীম হোসাইন বলেন, “এলাকায় দীর্ঘদিনের একটা মানসিক বিভাজন ছিল, সেটা এবার শেষ হলো। আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছি যেন সবাই একসঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে উৎসব উদযাপন করতে পারে। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার — এই নীতিতেই কাজ করেছি।”
পূজা উদযাপনে নেতৃত্বদানকারী শ্রী তরুণ কুমার মল্লিক বলেন, “প্রায় ৩৯ বছর পর নিজেদের জায়গায় দেবীর আরাধনা করতে পারছি—এটা আমাদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত। আমাদের পূর্বপুরুষেরা যেই জমিতে এই মন্দির গড়ে তুলেছিলেন, আজ সেখানে আবার পূজা হচ্ছে—এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।”এলাকাবাসী জানান, এবারের পূজাকে ঘিরে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো ইউনিয়নে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর মন্দির প্রাঙ্গণ আলোকসজ্জায় ঝলমল করছে। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই একত্রে মিলিত হয়ে উপভোগ করছেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আরতি ও প্রসাদ বিতরণের আয়োজন।
স্থানীয় প্রভাস মল্লিক বলেন,  “আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি এই মন্দিরের ইতিহাস, কিন্তু কখনও নিজস্ব জমিতে পূজা দেখিনি। এবার প্রথমবার দেখছি, মনে হচ্ছে পুরো গ্রামটাই যেন এক পরিবারের মতো হয়ে গেছে।” পাশাপাশি, প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ, গ্রামপুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবক দল দিনরাত পাহারায় নিয়োজিত রয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মন্দিরের আশপাশে সিসিটিভি ক্যামেরাও স্থাপন করা হয়েছে। ধর্মীয় সম্প্রীতির এই অনন্য উদাহরণে এলাকাবাসী গর্বিত। মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকে পূজামণ্ডপে এসে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এবং পূজা উদযাপন কমিটির পাশে দাঁড়িয়েছেন।
স্থানীয় শিক্ষক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, “এই পূজা শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উৎসব নয়, বরং আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক। এখানে সবাই মিলেমিশে কাজ করেছে, কেউ বিভেদ সৃষ্টি করেনি—এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য।” এলাকাবাসীর আশা, এই পূজাকে কেন্দ্র করে নতুন প্রজন্ম ঐক্য ও সহমর্মিতার শিক্ষা পাবে। পাশাপাশি, এ উদযাপন ভবিষ্যতে স্থানীয় সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতির নতুন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
শেয়ার করুন